এই সমাজে যত পথ হেঁটেছি, যত মানুষ দেখেছি—একটি বেদনাদায়ক সত্য আমার সামনে বারবার দাঁড়িয়েছে: ইমাম ও খতিবরা এই দেশের সবচেয়ে অবহেলিত অথচ সবচেয়ে অপরিহার্য নেতৃত্ব।
আমরা তাদের ভাতা দিই, সামান্য বেতন দিই, আবার নিজেদেরকে মনে করি তাদের প্রতি উপকার করছি!
বাস্তবে আমরা যেন তাদের সম্মান, মর্যাদা ও নেতৃত্বের প্রধান আসনটাই কেড়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি—ইমাম ও খতিব কেবল মসজিদের ‘স্টাফ’ নন; তারা পুরো এলাকার নৈতিক রক্ষণাবেক্ষক, মানুষের প্রথম আস্থার ঠিকানা এবং সমাজের প্রকৃত অভিভাবক। অথচ মহল্লার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তাদের মতামত থাকে না, কমিটি তাদের মাথার ওপর দিয়ে সব সিদ্ধান্ত নেয়, এবং তাদের মর্যাদা পদে নয়—ক্ষমতাবানদের ইচ্ছায় নির্ধারিত হয়।
এই বাস্তবতা শুধু কষ্টদায়ক নয়—এটা জাতির ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ।
মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়—১৯৭১ সাল থেকে স্বাধীনতার ৫৪ বছরের পথে আলেম-ওলামারা সবসময় দেশ ও জাতির কল্যাণে ছিলেন পরম ত্যাগ ও দায়িত্বশীলতার সাথে। অথচ গত ১৬ বছরে দেশে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আলেমগণ—এটা একটি জাতিগত আত্মহত্যার মতো।
জুলাই আন্দোলনে আলেম ও মাদ্রাসার ছাত্রদের ভূমিকাও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—এটি নতুন প্রজন্মকে দেখিয়ে দিয়েছে, সত্যিকারের নেতৃত্ব এখনো মিম্বার থেকেই উঠে আসে।
তবু বাস্তব পরিস্থিতি জটিল।
দেখা যায়—শতকরা ৯০% আলেম প্রকৃত ইসলামী পরিবর্তনের কাজ থেকে দূরে সরে, কমিটির আনুগত্যে ও চাপের সংস্কৃতিতে আটকে থাকেন। যার ফলে প্রকৃত ইমাম ও খতিবরা লাঞ্ছিত হন, সমাজের সামনে ইমামতি অনেক সময়ই নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি—এই সংস্কৃতি যতদিন থাকবে, সমাজ মুক্তি পাবে না।
এখন সময়—ইমাম ও খতিবদের মর্যাদাকে বাস্তবে পরিণত করার।
তাদের ভাতা নয়, সর্বোচ্চ সম্মানী দিতে হবে।
সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে, রাজনীতি–অর্থনীতি–সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তাদের প্রধান আসনে বসাতে হবে।
বিবাদ–মীমাংসায় তাদের রায়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মসজিদ কমিটির সবচেয়ে প্রভাবশালী পদে ইমাম–খতিবকেই রাখতে হবে—কারণ এলাকাটাকে তারা-ই জানেন, মানুষকে তারা-ই বোঝেন।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি—
যেদিন ইমাম ও খতিব সত্যিকার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবেন—
সেদিন সমাজে সত্যের আলো জ্বলে উঠবে,
ন্যায় অন্যায়কে পরাজিত করবে,
আর এই জাতি সঠিক পথে ফেরার শক্তি ফিরে পাবে।
আজ আমাদের সামনে দুইটি পথ—
একটি পথ ইমাম–খতিবদের বঞ্চনা অব্যাহত রাখে,
অন্য পথ তাদের সম্মানকে নেতৃত্বের পর্যায়ে উন্নীত করে।
আমি দ্বিতীয় পথেই বিশ্বাস করি।
কারণ ইমাম ও খতিবদের সম্মান প্রতিষ্ঠা মানে—
সমাজের নৈতিক পুনর্জাগরণ,
সত্যের পুনঃস্থাপন,
এবং একটি আলোকিত প্রজন্মের নিশ্চয়তা।
হাফেজ মুতাছিম বিল্লাহ ফুয়াদ
দাওয়াহ কর্মী ও সমাজ চিন্তক