স্টাফ রিপোর্টার, আরিফুল ইসলাম মুরাদ, নেত্রকোনা
সুনামগঞ্জের শিল্পনগরী ছাতক-ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের (রজ্জুপথ) হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। ইতিমধ্যে কয়েক কোটি টাকার এসব সরকারি সম্পদ চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈকি মহল ও সুশীল সমাজের দাবি, সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষের সুষ্টু তদারকির অভাবে রোপওয়ের অস্তিত্ব এখন অনেকটাই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৬৬ সালে ভারতীয় সীমান্তবর্তী ভোলাগঞ্জের পাথর ছাতকে নিয়ে আসার লক্ষ্যে রেল বিভাগ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন রজ্জুপথ ছাতক-ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এরপর ১৯৬৮ সালে প্রকল্পে ১৯ কিমি. দীর্ঘ রজ্জুপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ কাজ শেষে ১৯৭০ সালে এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলে ১শ’ ৭০ ঘণ্টা সচল থাকার পর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ায় এটি বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ বিভিন্ন স্থাপনায় প্রায় ৫০ কোটি টাকার সংস্কার কাজ শেষে এ পথে ১৯৭৮ সালে ফের পাথর পরিবহন কার্যক্রম শুরু করেন। বর্তমানে ১ লাখ ২০ হাজার ফুট দীর্ঘ তারের বেষ্টনীতে ৪শ’২৫টি বাকেট পাথর পরিবহন কাজে সচল রয়েছে। প্রতি বাকেটে পাথরের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ১২.৯২ ঘনফুট (৬শ’কেজি)। রেলওয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, এ প্রজেক্ট বন্ধ হলে রেল বিভাগকে উচ্চমূল্যে পাথর ক্রয় করে সারা দেশের রেলপথ সচল রাখতে হবে। এতে প্রতিবছর রেল বিভাগের কোটি কোটি টাকার আর্থিক ব্যায় বাড়বে। ছাতকে চুনাপাথর আমদানিকারক আয়না মিয়াসহ একাধিক লোকজন জানান, অবহেলা ও জনবল সংকটের মুখে ৫ বছর ধরে প্রকল্পটি বন্ধ থাকায় ট্রেসেলসহ কয়েক কোটি টাকার মালামাল সংঘবদ্ধ চোরচক্রের সদস্যরা বিক্রি করে দিচ্ছে। দেশের একমাত্র বৃহত্তম ছাতক-ভোলাগঞ্জে রোপওয়ে রজ্জুপথটি দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর ধরে পরিত্যক্ত রয়েছে। অযতœ-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে সরকারি হাজার হাজার কোটি টাকার মুল্যবান মালামাল। প্রতি রাতেই লাখ লাখ টাকার পাথর চুরি ও লুটপাট হচ্ছে। লুটপাটকারীদের সঙ্গে হাত রেলওয়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকতা, কর্মচারি ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। এদের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক লুটপাট ও দুনীতি অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ৩শত ৫৯ একর ভুমি জায়গা নিয়ে ছাতক ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে এ প্রকল্পটি চালু হয়। এ অবস্থায় কবে এটা চালু হবে,তা ও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না । জানা যায়, ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে লাভজনক এ রজ্জুপথ বন্ধ রয়েছে। ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রোপওয়ের ট্রেসেল (খুঁটি) সংখ্যা ১২০টি। প্রাকৃতিক দুযোগের কারনে ইতিমধ্যে ৫টি ট্রেসেল নদীতে পড়ে গেছে এবং ৮টি ট্রেসেল হেলে আছে। দুস্কৃতিকারিরা রাতে আধারে বিভিন্ন কৌশল রোপওয়ের তামার তার,বাকেট,ট্রেসেল ও লৌহাজাতীয় সরঞ্জাম প্রতিরাতেই চুরি হচ্ছে। এসব দেখার কেউ নেই। চারটি (ছাতক, অ্যাংগেল এক, অ্যাংগেল দুই ও ভোলাগঞ্জ)। বাকেট সংখ্যা ৪শ’২৫টি। ২০১৩ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত চালু ছিল ২শ’৪৬টি বাকেট। প্রতি বাকেটের ধারণক্ষমতা ১২.৯২ ঘন ফুট (৬০০ কেজি)। রোপওয়েটির বার্ষিক পাথর পরিবহন ক্ষমতা ছিল প্রায় ১২ লাখ ঘন ফুট। বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অবহেলায় বিভিন্ন স্থানে রোপওয়ের কিছু ট্রেসেল হেলে পড়েছে। তার ছিঁড়ে একাধিক বাকেটও মাটিতে পড়ে আছে। ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে এ প্রকল্পটি চালু জন্য কতৃপক্ষ টেন্ডার আহবান করা হয়েছিল। রহস্যজনক কারনে বন্ধ হয়ে যায়। দেশের রেলওয়ের আওতাধীন ছাতক-ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা ও অবহেলায় দীর্ঘ ১১ বছর ধরেই অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে হাজার কোটি টাকা পাথর কোয়ারী। এলাকাটি সংরক্ষিত হলেও রাতের আঁধারে পাথর চুরির কারণে এটি বিরাণ ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা ধলাই নদীর সাথে প্রতি বছর বর্ষাকালে নেমে আসে প্রচুর পাথর। ধলাই নদীর তলদেশেও রয়েছে পাথরের বিপুল মজুত। এই পাথর দিয়ে ৫০ বছর চালানো যাবে- এই হিসাব ধরে ১৯৬৪-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে সোয়া ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ছাতক ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্পটি। ব্রিটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ রোপওয়ের জন্য নির্মাণ করা হয় ১২০টি টাওয়ার এক্সক্যাভেশন প্যান্ট। মধ্যখানে চারটি সাব স্টেশন-যেগুলো স্থানীয়ভাবে ‘এঙ্গেল’ নাম পরিচিত। দুই প্রান্তে ডিজেলচালিত দুটি ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউস, ভোলাগঞ্জে রেলওয়ে কলোনী, স্কুল, মসজিদ ও রেস্ট হাউস নির্মাণও প্রকল্পের আওতাভুক্ত ছিল প্যান্ট। মধ্যখানে চারটি সাব স্টেশন-যেগুলো স্থানীয়ভাবে ‘এঙ্গেল’ নামে পরিচিত। দুই প্রান্তে ডিজেলচালিত দুটি ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউস, ভোলাগঞ্জে রেলওয়ে কলোনী, স্কুল, মসজিদ ও রেস্ট হাউস নির্মাণও প্রকল্পের আওতাভুক্ত ছিল। এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্টের সাহায্যে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাথর উত্তোলন করা হলেও বর্তমানে এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো। ভারতের ওমঘাট নদী বাংলাদেশে ধলাই নামে প্রবেশ করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্ল্যান্টের চারপাশ ঘুরে আবার একীভূত হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের কাছে ধলাই নদী মিলিত হয়- পিয়াইন নদীর সঙ্গে। যে কারণে এ স্থাপনাটি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে । সুত্রে জানায়, ছাতকে প্রাইম সিমেন্ট কোম্পানি লি. কর্তৃপক্ষ পাথর পরিবহনের জন্য ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের যন্ত্রপাতি ও পাথর কোয়ারির জমিসহ ৫০ বছরের জন্য লিজ নেয়ার আবেদন করেন বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কাছে। এ লিজের বিরুদ্ধে ছাতক উপজেলার কালারুকা ইউপির মুক্তিগাও গ্রামের সাবেক মেম্বার জাপার নেতা প্রয়াত নুরুল হক বাদী হয়ে রেল কর্তৃপক্ষ বরাবরে ইজারা না দেয়ার জন্য লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। স্থানীয়রা জানান, সর্বনিম্ন ২০ ফুট থেকে ১৬৭ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ট্রেসেলের ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ক্যাবল কারে নদী, টিলা ও হাওরের ওপর দিয়ে সাদা পাথর ভ্রমণ ও মেঘালয়ের নীল পাহাড়ের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করা যাবে। তারা বলেন, ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে সাদা পাথর ও ভোলাগঞ্জ বর্ডার হাটের একেবারে পাশে অবস্থিত। এর ফলে সুনামগঞ্জ-ছাতকসহ দেশ-বিদেশি পর্যটকদের সাদাপাথর ঘুরে দেখার আগ্রহ সৃষ্টি হবে। শিল্পনগরী ছাতকের ব্যবসায়ীরাও সহজে ভোলাগঞ্জে যাতায়াত করতে পারবেন। এর মাধ্যমে সরকার বিপুল রাজস্ব আয় করতে পারবে। গত ১৬ অক্টোবর ২০২২ সালে চট্রগ্রাম পুর্ব অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলীর বাংলাদেশ রেলওয়ে বিভাগের ছাতক রেলওয়ে অফিস থেকে ছাতক থেকে ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে পযন্ত পরিবহনে ব্যবহৃত রোপওয়ে যন্ত্রপাতি রক্ষনাবেক্ষন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে কতৃপক্ষকে লিখিতভাবে জাননো হয়। এখনো কোন দিক নিদেশনামুলক উত্তর ও পত্র আসেনি ছাতকে। এ ছাড়া ভোলাগঞ্জ ব্যাংকার ও রেস্টহাউজ সহ বড় মেশিনারীসহ এলাকার ২৫জন কমচারি আর এন,বি সদস্যদের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন একজন। এব্যাপারে শিক্ষক মানিক মিয়া ও রেজ্জাদ আহমদ জানান ভোলাগঞ্জ সাদার পাথর পর্যটন কেন্দ্র দেখার জন্য প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন এসে ভিড় করেন। ছাতক চুনাপাথর আমদানিকারক ও সরবরাহ গ্রুপের সভাপতি আহমদ শাখাওয়াত সেলিম চৌধুরী জানান অযতেœ-অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সরকারি বিপুল অর্থের সম্পদ। ছাতক-ভোলাগঞ্জ রোপওয়েকে পর্যটন খাতে ব্যবহার করা গেলে এটি হবে অপার সম্ভবনাময় ও লাভজনক। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের এগিয়ে আসতে হবে। এব্যাপারে ছাতক প্রেসক্লাবের সভাপতি গিয়াস উদ্দিন তালুকদার ও সাধারন সম্পাদক আনোয়ার হোসেন রনি,কাজি রেজাউল করিম রেজা জানান,দেশের একমাত্র রজ্জুপথ ছাতক-ভোলাগঞ্জের রোপওয়ে। দীর্ঘদিন যাবৎ অবহেলা আর অযতেœ নষ্ট হচ্ছে সরকারের হাজার কোটি টাকার মুল্যবান মালামাল। এটাকে সংস্কার করে তা পর্যটনের কাজে ব্যবহার করলে সরকারের পাশি ছাতকে মানুষ জনের বিকল্প একটা আয়ের দ্বার উন্মুক্ত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ছাতকে দীর্ঘদিন থেকে ধরেই রজ্জুপথটি বন্ধ থাকার নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে ছাতক ও সিলেট অফিসে একাধিক কর্মকতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা এ ব্যাপারে কেউ বক্তব্য দিতে নারাজ। এব্যাপারে চট্রগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর এর সঙ্গে একাধিক বার তার ব্যক্তি নম্বারের কল হচ্ছে, কেউ রিসিভ করেনি।